আশির দশকের শেষে এবং নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়। কি সুবর্ণ দিন ছিল আমারও! মঞ্চ নাটকের জমজমাট আয়োজন ছিল তখন! সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর শিক্ষার পাঠ চুকিয়েছি! জাতীয় সাংবাদিকতারও মোহ! মূল শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) অবস্থিত আবৃত্তি, সাংস্কৃতিক ও নাট্য সংগঠন, নৃত্যকলা, সাইন্স ল্যাবরেটরির ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, সুস্থ ও সুন্দর চলচ্চিত্রে বিকাশের জন্য ফিল্ম সোসাইটির আন্দোলন, ধানমন্ডি শংকরে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স, শিল্পকলা ও চিত্রকলার ওপর কর্মশালা, প্রশিক্ষণে নানা সনদ লাভ হয়ে গেছে এরই মধ্যে। মননে সৃষ্টির উল্লাসে অদম্য ইচ্ছাশক্তি আমার ! প্রদায়ক হিসেবে চিত্র সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়েছি।
.দর্শক হিসেবে লেখক
মাসিক নিপুন, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, রোববার, সচিত্র সন্ধানী, চিত্রবাংলা, সুচিত্রা, ছায়াছন্দ ইত্যাদিতে মৌলিক সাহিত্যের সঙ্গে মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের বিষয়ে প্রচুর ফিচার, প্রতিবেদন ও সমালোচনা লিখতাম! চলচ্চিত্র, টিভি এবং মঞ্চ অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হবে এমন কারণও ছিল এ চিত্র সাংবাদিকতায় প্রবেশের পিছনে! তাই তেজগাঁও এফডিসি, বারী, বেঙ্গল, পপুলার, শ্রুতি ও এলভিস রেকর্ডিং স্টুডিও, রামপুরা টিভি সম্প্রচার কেন্দ্র ও শাহবাগ বেতার ভবন ইত্যাদি ছিল আমার পেশা ও নেশার চেনা জায়গা। আর ওই সোনালী দিনগুলোতে সবচেয়ে বেশি সময় কেটেছে সেগুন বাগিচার শিল্পকলা একাডেমী এবং বেইলী রোডের নাটকপাড়ায়। মহিলা সমিতি এবং গার্লস গাইড মিলনায়তনে নাটক সমালোচনা, নতুন মঞ্চ নাটকের ওপর প্রতিবেদন তৈরি এবং অভিনয় শিল্পীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য বিকেল থেকে রাত অবধি অনেক সময় কাটিয়েছি। ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানসহ দেশের থিয়েটার, নাগরিক, আরণ্যক, পদাতিক, ঢাকা পদাতিক, ঢাকা থিয়েটার, নাট্যচক্র, থিয়েটার আর্ট, ঢাকা নাট্যম, ঢাকা ড্রামা, প্রতিদ্বন্দ্বী থিয়েটার, মতিঝিল থিয়েটার ও তীর্যক, সুবচনসহ ঢাকা ও চট্টগ্রামের বহু নাট্যদলের প্রযোজনা আমি দেখেছি এবং লিখেছি। এসব দেখেছিলাম পেশার কারণে সৌজন্য টিকিট ও আমন্ত্রণপত্রের বদৌলতে ।
শেষের কবিতা নাটকে নূনা আফরোজ ও সহশিল্পী
সেই দিনগুলো এখন অপসৃয়মান। বর্তমান ডিজিটাল যুগে নিকট অতীত যেন ধূসর হয়ে যাচ্ছে! রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, সামাজিক মূল্যবোধ ও সচেতনতা বৃদ্ধি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্য দূরীকরণ এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের নাট্যদলগুলো দীর্ঘ আড়াই দশক বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে নিঃসন্দেহে। সে ভূমিকা আজকাল দেখা যায় না ! তথ্য ও প্রযুক্তি এবং শক্তিশালী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতাপে প্রিন্ট মিডিয়াগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। নেই সাহিত্য ও সংস্কৃতি সমালোচনার স্থানগুলো। তাই সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নৃত্যকলা, শিল্পকলা বিভিন্ন মিডিয়ায় আগের মতো ব্যাপকভাবে সমালোচনা হয় না ! আজকাল সেই সোনালী অতীতকে আমার বেশ কাছে পেতে ইচ্ছে হয় ! অনেকদিন পরে আবার মঞ্চনাটক ! আধুনিক সজ্জা ও সুবিন্যস্ত উচ্চ ইমারতের মহিলা সমিতি মিলনায়তনের নাট্যমঞ্চকে আমার প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ স্পর্শ করতে পেরেছেন।
এর আয়োজক মহানগরীর কিশোরাত্তীর্ণ নাট্যদল প্রাঙ্গণেমোর। এবার সাংবাদিক হিসেবে নয়, দর্শনীর বিনিময়ে দর্শক হিসেবে নাটক দেখতে উপস্থিত হয়েছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা অবলম্বনে মঞ্চ নাটক 'শেষের কবিতা' ও ‘রক্তকরবী’ দেখতে গিয়েছি অতি সম্প্রতি। ছ’দিনের রবীন্দ্র মঞ্চ নাটকের উদ্বোধনী দিনে দেশের প্রাজ্ঞ নাট্যজন শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ ঠিকই বলেছেন, বাঙালি সত্তার জাগরণকে উজ্জীবিত রাখতে হলে রবীন্দ্র সাহিত্য ও নাটকের কাছে ফিরে আসতেই হবে আমাদের । মঞ্চ নাটক ২টির প্রযোজনাকেন্দ্রিক সমালোচনায় আমি আজ যাবো না ।
উপমহাদেশের বিশিষ্ট নাটজন শম্ভু মিত্রের সুরে আমিও বলবো রবীন্দ্র চর্চার বিকল্প নেই সেটা হোক জীবনের প্রেম ভালোবাসা, দ্রোহে, চেতনায় কিংবা প্রকৃতিগত সৌন্দর্য্যরে খেলায়। আস্তরিক ধন্যবাদ প্রাঙ্গণেমোর প্রধান অভিনয় শিল্পী নাট্যকার ও নির্দেশক অনস্ত হীরা এবং 'শেষের কবিতা' মঞ্চ নাটকের লাবণ্য এবং ‘রক্তকরবী'র নন্দিনী রূপী অভিনেত্রী এবং নব মঞ্চ নাটক নির্দেশক নূনা আফরোজকে। জয় হোক সত্যের। রবীন্দ্র সাধনা ও চর্চায় হোক আমাদের প্রতিদিনের পথচলা। # লেখক সাহিত্যিক ও সাংবাদিক reporterpranab@gmail.com